জেনারেল টিক্কা খান তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমি মাটি চাই, মানুষ নয়"

‘জেনারেল টিক্কা খান তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমি মাটি চাই, মানুষ নয়" '

জেনারেল টিক্কা খান

কসাই টিক্কা নামেই তিনি পরিচিত। তার স্বদেশি পাকিস্তানিরাই তাকে এ নামে ডাকতো। ১৯৭০ সালে বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ দমনে জেনারেল টিক্কা খান নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালান। সেজন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরাই তাকে বেলুচিস্তানের কসাই নামে কুখ্যাতি দেয়।

বালুচিস্তানে বর্বর হত্যাযজ্ঞের পর পাকিস্তানের শাসকচক্র পূর্ব পাকিস্তানকেও একটি কসাইখানা বানাতে চেয়েছিল। তারা গণতন্ত্র পুন‍ঃপ্রতিষ্ঠার নামে নানা টালবাহানা করতে থাকলো আর তলে তলে বাংলাকে রক্তাক্ত করার জন্য  ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকলো। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পূর্ব পাকিস্তানের সব দায়িত্বপূর্ণ পদে পশ্চিম পাকিস্তানে নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত ব্যক্তিদের বসানো হলো। এ তালিকায় যোগ হন জেনারেল টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী খান, আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীসহ অনেকেই।  
 
টিক্কা খানের আগে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ছিলেন ইয়াকুল আলী খান। একাত্তরের মার্চে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে করাচির পথ ধরেন। ইয়াকুব আলীর পরেই ইয়াহিয়া বালুচিস্তানের কসাই জেনারেল টিক্কা খানকে এখানকার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। ইয়াহিয়ার গণহত্যা পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই টিক্কা খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

একদিকে ইয়াহিয়া আলোচনা-নাটক চালিয়ে যেতে থাকলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে, আরেকদিকে পর্দার অন্তরালে জেনারেল টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী ও আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীকে প্রস্তুত করতে থাকলেন গণহত্যার জন্য। এর পেছনে আরেক ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টো। রাজনৈতিক মঞ্চে অভিনয় করে গেলেন ভুট্টো-ইয়াহিয়া, আর সামরিক মঞ্চ পোক্ত করতে থাকলেন টিক্কা, রাও ফরমান আলী ও নিয়াজী।
 
নিয়াজী তার আত্মজীবনীমূলক ‘The betrayal of East Pakistan’ বইয়ে একাত্তরের ঘটনাবলীর বর্ণনা দেন। সেই বর্ণনায়ই পাওয়া যায় গণহত্যার পরিকল্পনা-নির্দেশা আর বাস্তবায়নের কথা।
 
নিয়াজী ২৫ মার্চের গণহত্যার জন্য টিক্কা-ইয়াহিয়া-ভুট্টো-রাও ফরমান আলীকে দায়ী করে বলেন, ‘সশস্ত্র বাঙালি ইউনিট ও ব্যক্তিবর্গকে নিরস্ত্র এবং বাঙালি নেতৃত্বকে গ্রেফতার করার জন্য টিক্কা খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু টিক্কা এ দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা এবং পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিক্কা তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমি মাটি চাই, মানুষ নয়” ।’
 
টিক্কার নির্দেশ পালন করার জন্য পাকিস্তান সরকার মেজর জেনারেল রাও ফরমান ও ব্রিগেডিয়ার (পরে জেনারেল) জাহানজেব আবরারকে নিয়োগ করেন। টিক্কার নির্দেশে ও রাও ফরমান আলীর পরিচালনায় সংঘটিত হয় ২৫ মার্চের গণহত্যা।
বাংলার কসাই
 
নিয়াজী বলেন, ‘তখনো বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করেনি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেনারেল টিক্কা খানের পর্যাপ্ত শক্তি ছিল। শুধু প্রয়োজন ছিল যথার্থ পরিকল্পনা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অভিযান পরিকল্পনা ও ধৈর্য্য।’
১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ মধ্যবর্তী রাতে জেনারেল টিক্কা আঘাত হানেন। একটি শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। চারদিকে আর্তনাদ ও অগ্নিসংযোগ। জেনারেল টিক্কা তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, যেন তিনি তার নিজের বিপথগামী লোকের সঙ্গে নয়; কোনো শত্রুপক্ষের সঙ্গে লড়াই করছেন।
 
নিয়াজী ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের হিংস্রতা ও নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তুলনা করেন।
 
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার আগে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের আগে তিনি টিক্কাকে বলেন, ‘তাদের খুঁজে বের করো’।
২৫ মার্চের গণহত্যার পর টিক্কা, ফরমান ও আরবাবকে পিঠ চাপড়িয়ে অভিনন্দন জানান ভুট্টো। তিনি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশ্বাস দেন। ভুট্টো তার কথা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের পর টিক্কা খানকে পাকিস্তানের চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বাংলার কসাই
২৫ মার্চের গণহত্যার কারিগর বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খানকে পরে বাংলার কসাই হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ থেকে তিনি হলেন ‘বাংলার কসাই’। ইতিহাসে আজো তিনি ‘বাংলার কসাই’ নামেই ঘৃণীত।

কার্টেসীঃ Binoy Amin Binoy

No comments

Powered by Blogger.