মেজর ওবায়েদ স্যার

সবে ট্রেনিং শেষ করে ৫৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে জয়েন করেছি। আমার ব্যাচমেটরা জয়েন করেছে আরো তিনমাস আগেই। দুনিয়াদারি কিচ্ছু না বুঝা নতুন সৈনিক আমি রামু সেনানিবাসের বৈরি পরিবেশে এমনিতেই হতাশ। সন্ধ্যা হতেই এখানে হাতির পালে, বন্য শূকরের আনাগোণা শুরু হয়। জয়েন করার পরদিন দুরু দুরু বুকে অফিসে গেলাম। ইন্টারভিউ এর জন্য ব্যাটালিয়ন এ্যাডজুটেন্ট মেজর আব্দুর রাজ্জাক স্যারের রুমের সামনে ওয়েট করছি। ঠিক সেই সময় ট্রাউজার পরিহিত বিশাল বুকের ছাতিসমেত তশরীফ আনলেন এক ভদ্রলোক।
 আমাকে কাঁচুমাঁচু হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে হুংকার মারলেন কে তুমি? স্যালুট দিয়ে যেই বললাম স্যার আমি নবীন সৈনিক। বিশালদেহী ভদ্রলোক সাথে সাথে আরো কড়া হুংকার দিলেন দাড়িয়ে আছ কেন? পুশআপ লাগাও একশোটা। আমি আর সাত পাঁচ চিন্তা না করেই পুশআপ পজিশন হয়ে পুশআপ দিতে থাকলাম ননস্টপ। গুণে গুণে যখন আশিটা হলো তখন ভদ্রলোক বললেন উঠে দাড়াও।




 তোমার নাম কি?
স্যার সৈনিক আসিফ।
কি বললা? সৈনিক? হা হা হা হা।
সৈনিক হইতে দেরি আছে। তুমি হইলা রিক্রুট। শিখতে শিখতে সৈনিক হবা ঠিকাছে? 
জ্বি স্যার। 
যেখানেই থাকো ঠিক ১০ টায় আমার অফিসে দেখা করবা।

সুবেদার এ্যাডজুটেন্ট  সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার সেলিম স্যার বললেন তোর ভাগ্য ভালো পুশআপ দিতে দেরি করিসনাই আর ঠিক পজিশনে দিছিস। নাহলে তোর সামনের দিন কষ্ট হয়ে যাইতো। উনার কাছে জানতে পারলাম স্যার ইউনিটের টুআইসি মেজর ওবায়েদ স্যার। 

ঠিক ১০ টায় আমি স্যারের দরজায় হাজির হলাম। স্যার তখন ফুল ইউনিফর্মে ডেকোরেটেড। বুকে জ্বলজ্বল করছে হলুদ একটা ইনসিগনিয়া। যেটা দেখে যে কারো মনে হবে ইনি অন্য সবার থেকে স্পেশাল, একটু ইউনিক। সাক্ষাৎকারে স্যার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবই শুনলেন। তারপর বললেন যেটাই করো মন থেকে করো, নিজের জন্য করো৷ কাউকে বুঝ দেয়ার জন্য কোন কাজ করোনা। প্রথম ইন্টারভিউতে কোন এক অদম্য আকর্ষণে আমি স্যারের কাছে জিজ্ঞেস করে ফেললাম স্যার আপনার বুকে জ্বলজ্বল করছে জিনিসটা কি? 
স্যার হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেলেন এবং বললেন এটা কি তা বলবো ঠিকাছে কিন্তু শর্ত হলো সকালের বাকি বিশটা আর এখন একশোটা মোট একশো বিশটা পুশআপ দিয়ে যদি ঠাই উঠে দাড়াতে পারো তবেই বলবো এবং এটা অর্জন করার রাস্তা দেখাবো। আমি এক সেকেন্ডও চিন্তা না করে এক টানা একশো বিশটা পুশআপ দিলাম পাগলের মত। 

ঠিক এর একদিন পরই ব্যাটালিয়নে চিঠি এলো এসআইএন্ডটি কমান্ডো কোর্সের জন্য ভলান্টিয়ার সোলজার এবং অফিসার চায়। এই চিঠি আসছিলো রাতে। সকালে পিটিতে গিয়ে দেখি স্যার আমাকেই খুঁজছেন। তারপর দেখা হতেই বললেন ৩০ পাউন্ডের একটা ব্যাকপ্যাক রেডি করতে আর ইউনিফর্মের সাথে কম্ব্যাট বুট পরে আসতে। আমি দৌড়ে গিয়ে রেডি হয়ে আসতেই স্যার বললেন চলো আমার সাথে। 

আরপি গেইট দিয়ে দৌড়িয়ে রামু বাজার আবার রামু বাজার থেকে আরপি গেইট এই করে করে স্যার ১৫ দিনে কমান্ডো প্রাথমিক বাচাই পরীক্ষার জন্য তৈরি করে ফেললেন। 

এর মাসখানেক পরেই আমি প্রশিক্ষণে চলে যাই। এরপর বেশ কয়েক বছর স্যারের সাথে আমার দেখা হয়নি। ২০১৭ সালের দিকে আম্মাকে নিয়ে সিএমএইচ যাচ্ছি। পড়নে কমান্ডো টি শার্ট। একটা আর্মি জীপ দেখলাম ওভারটেক করে গিয়ে আবার ব্যাক করে আসছে। পাশাপাশি এসে রিকশা থামতেই দেখলাম ওবায়েদ স্যার। স্যার আমাকে চেনেননি আসলে। ওভারটেক করার সময় জাস্ট লুকিং গ্লাস দিয়ে টিশার্টে কমান্ডো ইনসিগনিয়াটা দেখেই উনি ব্যাক করেছেন। গাড়ি থেকে নেমে জড়িয়ে ধরলেন, আমাদেরকে সিএমএইচ পৌঁছে দিলেন। একজন কমান্ডো ছাত্রের দীক্ষাগুরুর নিকটে থেকে এটা অনেক বড় পাওয়া। 

সেনাবাহিনীতে কমান্ডো জগতে মেজর ওবায়েদ স্যারের নাম শুনেনি ওরকম লোক পাওয়া মুশকিল। একজন মানুষ শুধুমাত্র প্রশিক্ষণের প্রতি ডেডিকেটেড হয়ে উর্দ্ধতন এবং অধীনস্তদের এতটা ভালোবাসাও পেতে পারেন!!

মেজর ওবায়েদ স্যার আমাদের ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা স্যারকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য্যধারণ করার তৌফিক দান করুন।

Courtesy: Asiful Islam sir

No comments

Powered by Blogger.