বিশ্বের সেরা স্পেশাল ফোর্স: ইউএস নেভি সিলস
1: Navy SEALs United States
নেভি সিলস বিশ্বের সেরা স্পেশাল ফোর্সগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি পরিচিত। সিল (SEAL) শব্দটি মাধ্যমে সমুদ্র (Sea), বায়ু (Air) ও ভূমি (Land) বোঝানো হয়, আর ‘s’ ইংরেজি বহুবচনার্থে ব্যবহৃত হয়। অথাৎ নেভি সিলের সকল সদস্যদের আকাশ, নৌ ও স্থলে সমান ভাবে কাজ করার সক্ষমতা থাকতে হয়। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ নিয়ন্ত্রিত ওই সেনা দলকে সরকারিভাবে 'টিম সিক্স' বলে আখ্যায়িত করা হয়।
US Navy SEAls |
তবে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর শাখা স্পেশাল ওয়ারফেয়ার কমব্যাটেন্ট-ক্র্যাফট ক্রুম্যান (SWCC) ও স্পেশাল অপারেশন্স ফোর্সেসের কিছু অংশের সমন্বয়ে এই বাহিনীর গঠিত হয়েছে। সরাসির সামরিক অভিযান ও বিশেষ গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনা করাই এ বাহিনীর মূল কাজ। এছাড়াও রীতিবহির্ভূত যুদ্ধ, বিদেশে আন্ত প্রতিরক্ষা, জিম্মি উদ্ধার, সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান, প্রভৃতি অভিযান পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও এ বাহিনী কাজ করে।
দুর্ধর্ষ সেনা দল গড়ে তোলার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসলই হলো বর্তমান নেভি সিল সেনা দল।
১৯৬২ সালে গঠিত হওয়া নেভি সীলদেরকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ স্পেশাল ফোর্স। নিজেদের অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে প্রতিনিয়ত অন্যান্য দলের সমীহ আদায় করে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর সবচেয়ে চৌকস এই সৈন্যদল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম, যুগোস্লাভিয়ান যুদ্ধসহ ইরাক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধেও নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে Sea, Air and Land-এর এই ফ্রগম্যানরা।
টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে সিলস যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমনে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ও পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে লাদেনকে হত্যার অভিযানে সিলস এবং সিআইএ একসঙ্গে কাজ করছে।
২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধী আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার অপারেশনের পুরোটুকুই হয়েছিলো নেভি সীল সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায়।
Navy SEALs motto |
নীতিবাক্যঃ-
"The Only Easy Day Was Yesterday"
(‘একটি দিনই শুধু সহজ ছিলো, তা হচ্ছে গতকাল’)
অন্যান্য ছদ্দনামঃ-
- Frogmen
- The Teams
- The Men with Green Faces
প্রশিক্ষনঃ-
একজন সৈনিকের নেভি সিল হয়ে ওঠার জন্য যেতে হয় অমানবিক এবং পাশবিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। নেভি সিলদের মোট ৩০ মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরিসংখ্যান মতে প্রতি ব্যাচে যে পরিমাণ সৈনিক নেভি সিল হওয়ার প্রশিক্ষণে যোগ দেয় তার মধ্যে কেবল ২৫ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। একজন নেভি সিল একইসঙ্গে ডাইভিং, কমব্যাট সাঁতার, প্যারাশুট পরিচালনা, নেভিগেশন এবং অস্ত্র পরিচালনার সবই সমান দক্ষতার সঙ্গে পারে।
নেভি সিলের প্রশিক্ষণে প্রথম দিন থেকেই যে বিষয়টির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় তা হল দলীয় একতা। কোন একক ব্যাক্তির স্বতন্ত্র দক্ষতার চেয়েও বেশি নজর দেওয়া হয় দলীয় দক্ষতা তৈরির ক্ষেত্রে। প্রশিক্ষণের প্রতিটা ধাপই এমনভাবে সাজানো হয় যেন সিলরা দলীয় একতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে। পরিসংখ্যান বলে যে, আজ পর্যন্ত কোন অপারেশনে কোন নেভি সিল ব্যর্থ হয়ে আসেনি। কিংবা কোন নেভি সিল অন্য নেভি সিলকে পেছনে ফেলে আসেনি। এটা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে তাদের দলীয় দক্ষতার কারণে।
নেভি সিলদের প্রথম দেয়া হয় ব্যাসিক আন্ডারওয়াটার ডেমোলিশন (বাড) ট্রেনিং। এই ট্রেনিংটি ইন্ডকট্রিনেশন, বেসিক কন্ডিশনিং, স্কুবা এবং ল্যান্ড-ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং-এই চার ভাগে বিভক্ত। বাড ট্রেনিংটি সম্পন্ন করতে মোট সময় লাগে সাত মাস। প্রথম পাঁচ সপ্তাহ চলতে থাকে ইন্ডকট্রিনেশন। এখানে মূলত নেভি সিল কিভাবে কাজ করে এবং তাদের কাছ থেকে কেমন কাজ আশা করা হয় এই সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়। এছাড়াও সামনে আসতে থাকা ভয়াবহ ও কঠিন প্রশিক্ষণের জন্য সিলদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। ইন্ডকট্রিনেশনের পরে আট সপ্তাহ ব্যাসিক কন্ডিশনিং, আট সপ্তাহ স্কুবা ট্রেনিং এবং নয় সপ্তাহ ল্যান্ড-ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং দেয়া হয়। এই সকল প্রশিক্ষণ করোনাডোর নেভাল অ্যাম্ফিবিয়াস সেইজে দেয়া হয়ে থাকে।
আট সপ্তাহের ব্যাসিক কন্ডিশনিং প্রশিক্ষণে সবচেয়ে বেশি নেভি সিল ঝরে পরে। এসময় একজন সিলকে প্রতিনিয়ত দৌড়, সাঁতার, ক্যালিস্থেনিকস, ছোট বোটের সাহায্যে অপারেশন সম্পন্ন করা, ১ থেকে ২ মাইল সমুদ্রে সাঁতার এবং নানান ধরণের বাঁধা দিয়ে সাজানো কোর্স সম্পন্ন করতে হয় নিয়ম মেনে। এই প্রশিক্ষণের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন অংশ হল ডাউন প্রুফিং। ডাউন প্রফিং এর সময় তাদের হাত পা বাঁধা অবস্থায় সাঁতার শিখতে হয়। কেবল সাঁতার নয়, শিখতে হয় ডিগবাজি দেয়াসহ নানান কসরত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ হল সার্ফ টর্চার। একে কোল্ড ওয়াটার কন্ডিশনিং ও বলা হয়ে থাকে। ১৮-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতে সিলদের বিভিন্ন ধরণের শারীরিক কসরত করতে বলা হয়।
নেভি সিলদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ভয়ঙ্কর শব্দটি হল ‘হেল উইক’। বেসিক কন্ডিশনিং প্রশিক্ষণের চতুর্থ সপ্তাহকে হেল উইক বলা হয়। এই সময়ে একজন সিল টানা পাঁচ দিন ও পাঁচ রাত প্রশিক্ষণ নেয় এবং এই পুরো সময়ে কেবল চার ঘণ্টা ঘুমানোর সময় পায়। এই সপ্তাহটি শুরু হয় রবিবার সন্ধ্যায় এবং শেষ হয় শুক্রবার রাতে। এই সময়ে সিলদের দিনে চারবার খেতে দেয়া হয় এবং এসময়ে তাদের গরম খাবার ব্যাতীত অন্য কোন খাবার খাওয়ায় রয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা। সিলরা যেন ঝিমিয়ে না পরে তার জন্যই তাদের গরম খাবার পরিবেশন করা হয়।
হেল উইকে সিলদের খাবারের সময় ছাড়া বাকি সকল সময়ে নানান ধরণের প্রশিক্ষণে ব্যস্ত রাখা হয়। প্রশিক্ষণ চলে কখনো পানিতে, কখনো মাটিতে কিংবা কাঁদা পানিতে। হেল উইকে ঘুমের অভাবে প্রায়ই সিলদের মস্তিস্ক নির্দেশ গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এই সময়ে প্রশিক্ষণের গুরুত্বপূর্ন অংশ থাকে যেকোন পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে নির্দেশনা গ্রহণ করা এবং তা মেনে চলা। প্রশিক্ষণের সময় যে সকল দল সঠিকভাবে নির্দেশ গ্রহণ করতে পারে তাদের পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয় দুই মিনিটের বিরতি কিংবা আগুনের পাশে দুই মিনিট দাড়ানোর অনুমতি। এর থেকেই ধারণা করা যায় কেন এই পাঁচ দিনকে হেল উইক আখ্যা দেয়া হয়েছে।
বেশিরভাগ অপারেশন থাকায় পানির, সিলদের আট সপ্তাহ স্কুবা এবং কমব্যাট সাঁতার এই প্রশিক্ষণে সবচেয়ে বেশি গুরত্ব পায়। নিবিড়ভাবে সজ্জিত স্কুবা সিস্টেম এবং আন্ডার ওয়াটার নেভিগেশনের মাধ্যমে এই পর্যায়ে সিলদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। নয় সপ্তাহ ব্যাপি ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং এর সময়টাতে সিলদের শেখানো হয় ভূখন্ডে যুদ্ধ ও অপারেশন পরিচালনার নানান কৌশল। এর মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশ, প্যাট্রোলিং এবং সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা। সেইসঙ্গে শেখানো হয় বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র পরিচালনা এবং এর আক্রমণ থেকে সুরক্ষার প্রশিক্ষণ। নেভি সিলদের সব ধরণের যানবাহন চালাতে জানা অতি আবশ্যক। এই সময়ে দ্রুত গতির সঙ্গে যানবাহন পরিচালনার নানা টেকনিকের উপরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সিলদের হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট, জরুরী প্রয়োজনে চিকিৎসা সেবা প্রদান, বিস্ফোরক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
বেসিক কন্ডিশনিং প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর যারা টিকে থাকে তাদের প্যারাসুট পরিচালনার জন্য পাঠানো হয় আর্মি এয়ারবোর্ন স্কুলে। তিন সপ্তাহের এই প্রশিক্ষণের পর শুরু হয় পনেরো সপ্তাহের সিল কোয়ালিফিকেশন ট্রেনিং। এই প্রশিক্ষণটি সাফল্যের সঙ্গে শেষ করার পর একজন সিলকে নেভাল এনলিস্টেড কোড এবং সিল ট্রাইডেন্ট পিন প্রদান করা হয়। এরপরে সিলদের বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই সকল ইউনিটে ভাগ হয়ে তাদের আবারো ১৫ থেকে ১৮ সপ্তাহের ট্রেনিং গ্রহণ করতে হয়। যারা হসপিটাল কোর্প্সম্যান বিভাগে যায় তাদের প্রয়োজন হয় ৩০ সপ্তাহের ট্রেনিং।
তবে নেভি সীলের সোনালী ব্যাজ অর্জন করতে হলেও সেনাদেরকে মুখোমুখি হতে হয় ভয়াবহ সব পরীক্ষার। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই ট্রেনিংয়ের হেল উইকেই বাদ পড়ে যায় বেশিরভাগ ট্রেইনি। ২৪ সপ্তাহের বাড/স ট্রেনিং এবং পরবর্তীতে ৩ সপ্তাহের প্যারাস্যুট ট্রেনিং এবং ২৬ সপ্তাহের কোয়ালিফিকেশন ট্রেনিং-এ উত্তীর্ণ হলেই অন্তর্ভুক্ত হওয়া যাবে এই গৌরবময় দলে।
ক্যাটাগরিতেঃ-
নেভি সিলরা যে ধরণের কাজ করে থাকে তাকে মূলত ৫ টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়।
১.আনকনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার: এই ক্ষেত্রে নেভি সিলেরা যুদ্ধে গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে থাকে। ছোট ছোট কমব্যাট দলে ভাগ হয়ে শত্রুদের পরাহত করা, যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটানো, শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে ডাইভারশন সৃষ্টি করা এই ক্যাটাগরির আওতায় পরে।
২.ফরেন ইন্টারনাল ডিফেন্স: এই ক্যাটাগরির আওতায় মূলত অন্য দেশের নাগরিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যেন তারা নিজ দেশে ইউ এস নেভি সিলের অপারেশন পরিচালনায় সহায়তা করতে পারে। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের সময় নেভি সিল ১৩ জন কুয়েতি নাগরিককে প্রশিক্ষণ দেয়।
৩.ডিরেক্ট অ্যাকশন: একটি শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা করা। যেমন জলে বা স্থলে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ, অ্যামবুশ, জিম্মি ব্যাক্তিদের উদ্ধার ইত্যাদি এই ক্যাটাগরির আওতাধীন।
৪.কাউন্টার টেরোরিজম: টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা, অ্যান্টি-টেরোরিস্ট কার্য পরিচালনা, নিজের দেশের নাগরিকদের যেকোন ধরণের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা হল এই ক্যাটাগরির কাজ।
৫.স্পেশাল রিকোনাইসেন্স: শত্রুপক্ষের গতিবিধি নজরদারিতে রাখা, বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনার পূর্বে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করা, অভিযানের নকশা প্রদান করা হল এই ক্যাটাগরির আওতাধীন।
সদস্য সংখ্যাঃ-
২০০৯ সাল থেকে সিল সেনার সংখ্যা ২ হাজার ৫৮০। অভাবনীয় শারীরিক দক্ষতার কারণে তারা কেবল সব ধরনের লড়াইয়ে পারদর্শীই নয়, কৌশলগত দিক থেকেও বিশেষজ্ঞ।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নেভি সিল সেনারা ৩০+টি দেশে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই ও মিশনে নিয়োজিত। বিশ্বে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে তারা হানা দিতে অক্ষম। নেভি সিল সদস্যরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক, আফগানিস্তানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অসংখ্য সফল অভিযান চালিয়েছে।
No comments